Dhaka ০৬:১১ অপরাহ্ন, বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ১৬ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ:
দুর্গাপূজার শক্তিশালী অর্থনৈতিক বিস্তার মিয়ানমার-আরাকান আর্মির ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চাপ সৃষ্টি করতে হবে দুর্গাপূজা প্রকৃতি ও মানবিক সম্পর্কের প্রতি গভীর ভালোবাসার বার্তা বহন করে : মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছুঁইছুঁই একাদশে বিশেষ কোটায় ভর্তি হলেন ৬০ শিক্ষার্থী কুড়িগ্রামে নদী ভাঙন বেড়েছে, পাউবোর বরাদ্দের অপেক্ষা ক্রিকেটে বিনিয়োগ করছে সৌদি আরব, আয়োজন করবে ফ্যাঞ্চাইজি লিগ নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করেছে এনসিপি : ইসি ১৫ বছর পর মানব পাচার মামলায় আসামির যাবজ্জীবন মনোনয়নের বৈধতা পেলেন রেদুয়ান, নির্বাচন করতে হচ্ছে বুলবুল-ফাহিমকে

দুর্গাপূজার শক্তিশালী অর্থনৈতিক বিস্তার

  • রুনা সাহা
  • Update Time : ০৬:৫৩:২৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ৫ Time View

শরতের শুভ্র আকাশ, কাশফুলের হাওয়ার নাচন, শিশির ভেজা ঘাসের ওপর শিউলি ফুল আর আগমনী ঢাক-শাঁখের আওয়াজ জানান দিচ্ছে গৌরি মর্তলোকে এলো বলে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একাধিক ধর্মীয় উৎসব থাকলেও, আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতার দিক থেকে দুর্গাপূজাই বড় আসনটি দখল করে রেখেছে।

দুর্গোৎসব কেবল ধর্মীয় উৎসবই নয়, এটি একটি সর্বজনীন উৎসব যেখানে ঐতিহ্য, পরম্পরা, খাওয়া-দাওয়া, সংস্কৃতি, আচার, ঘোরাঘুরি, বাণিজ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। হিন্দু ঐতিহ্যের গভীরে নিহিত এই উৎসব শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি এত উৎসাহ এবং অন্তর্ভুক্তির সাথে উদযাপিত হয় যে যেখানে সব স্তরের, সব শ্রেণিপেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেয়।

অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর অনেক মানুষই এই উৎসবের আচার-অনুষ্ঠান, পূজার প্যান্ডেল পরিদর্শনসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উৎসাহ উদ্দীপনায় উপভোগ করে। এই উন্মুক্ত উদযাপন এবং ধর্মীয় সহনশীলতা বাংলাদেশকে এক ধর্মীয় নিরপেক্ষ জাতির উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে।

গোটা বাংলায় সপরিবারে দুর্গা প্রতিমার পূজার প্রচলন প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৪৮০ সালে রাজশাহীর জেলার তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণের পূজায়। তবে বাংলায় পারিবারিক দুর্গাপূজার প্রচলন মোটামুটি ১৬১০ সালে বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পূজা আয়োজনের মাধ্যমে।

শরৎকালীন দুর্গাপূজার সর্বোচ্চ প্রসার ও প্রচার লাভ করে ১৭৫৭ সালে কৃষ্ণনগরের অধিপতি নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর এবং শোভাবাজার রাজবাড়ীর পূজা আয়োজনের পর থেকেই। ইতিহাসে কথিত আছে, জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে পলাশীর যুদ্ধ জয়ের পরে ক্লাইভ গির্জায় না গিয়ে আনন্দ উৎসবের জন্য দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন।

আগে সমাজের বর্ধিষ্ণু সম্প্রদায়—জমিদার, তালুকদার বা অন্যান্য বৈভবশালী পরিবারই দুর্গাপূজা করতেন। কালের অন্তরালে বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার পর পূজায় ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়। ১৭৯০ সালে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার বারোজন ব্রাহ্মণ যুবকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল দুর্গাপূজার। বারো ইয়ার বা বন্ধু মিলে ওই পূজা ‘বারোইয়ারি’ বা ‘বারোয়ারি’ পূজা নামে খ্যাত হয়ে আছে। সেদিনের সেই ‘বারোয়ারি’ কথাটি ধীরে ধীরে আজকের ‘সর্বজনীন’-এ রূপ নেয়।

দুর্গাপূজা ধর্মীয় তাৎপর্যের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। জীবনের সব রং ছুঁয়ে পূজার অর্থনৈতিক প্রভাব শুধু শহরে সীমাবদ্ধ থাকে না, গ্রাম থেকে শুরু করে মফস্বল পর্যন্ত সর্বত্র এর প্রভাব দেখা যায়। ব্যবসা বাণিজ্যে আসে গণজোয়ার।
পরিসংখ্যানিক হিসাব মতে বাংলাদেশে ২০২১ সালে পূজামণ্ডপের সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ১২২। ২০২২ সালে মণ্ডপের সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ হাজার ১৬৮-এ, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে দুর্গাপূজার মোট মণ্ডপের সংখ্যা ছিল ৩২,৪৬০টি, ২০২৪ সালে এটি কমে ৩১,৪৬১টি মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০২৫ সালে সারা বাংলাদেশে মোট ৩৩ হাজার ৫৭৬টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধি মণ্ডপ বৃদ্ধির কারণ নয়। যেহেতু মণ্ডপের সঙ্গে ভিন্ন মাত্রার মর্যাদা জড়িত এবং তাই আর্থিক সংকুলানের ব্যবস্থা করতে পারলেই মণ্ডপের সংখ্যা বাড়ে। ব্যক্তিগত আর্থিক কার্যকলাপের সাথে সাথে বর্তমানে সরকারি আর্থিক প্রণোদনা যোগ হচ্ছে। দেশের সব দুর্গাপূজা মণ্ডপের জন্য ২০২৩ সালের সরকারি বরাদ্দ ছিল ২ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে দুর্গাপূজা উদযাপনের জন্য ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। ২০২৫ পূজায় সরকারের পক্ষ থেকে ৫ কোটি টাকার অনুদান দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

দুর্গাপূজার মূল পাঁচ দিন হলো ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং বিজয়া দশমী। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথি থেকে এই পাঁচ দিনের দুর্গোৎসব শুরু হয় এবং বিজয়া দশমীর মাধ্যমে শেষ হয়। বেশ কিছু মণ্ডপে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয় মহাষ্টমী তিথিতে, যেখানে নবদুর্গার নয়টি রূপকে প্রতিনিধিত্বকারী কুমারী কন্যাদের দেবী রূপে পূজা করা হয়।

কুমারী পূজার মাধ্যমে একদিকে যেমন নারীর পবিত্রতা ও সম্মানকে তুলে ধরা হয়, তেমনই সমাজের নারীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। এর ফলে সমাজে নারী শিক্ষা ও নারীর কর্মসংস্থানেও পরোক্ষভাবে উৎসাহিত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। জাতি, ধর্ম, বর্ণের ঊর্ধ্বে শারদোৎসব।

যে বৈদিক সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণে দেবীর আরাধনা হয় সেই সংস্কৃত শব্দকোষে কেবল সব মনুষ্য জাতির নয়, রয়েছে জগতের সব পশুপাখি এবং গাছপালাসহ সবার মঙ্গল কামনার উদাত্ত প্রকাশ। বিজয়া দশমী অশুভ শক্তির ওপর বিজয়ের প্রতীক এবং এর মাধ্যমে মন্দের বিনাশের বার্তা দেওয়া হয়। দশমীতে মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে মিষ্টান্ন শিল্প, খাদ্যশিল্পে যোগ হয় বিক্রয়ের দোলা।

বর্তমানে দুর্গাপূজা শুধু মন্ত্র উচ্চারণ ও আচার অনুষ্ঠান পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন দুর্গাপূজা ধর্মীয় তাৎপর্যের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। জীবনের সব রং ছুঁয়ে পূজার অর্থনৈতিক প্রভাব শুধু শহরে সীমাবদ্ধ থাকে না, গ্রাম থেকে শুরু করে মফস্বল পর্যন্ত সর্বত্র এর প্রভাব দেখা যায়। ব্যবসা বাণিজ্যে আসে গণজোয়ার।

সব মিলে মিশে দুর্গাপূজা বর্তমানে এক মহা মিলনমেলা ও বাণিজ্যমেলায় পরিণত হয়েছে। সামাজিক বিনিয়োগের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন সামাজিক বন্ধনকে মজবুত করে। যোগ হয় সাংস্কৃতিক বিনিয়োগও। পূজা এখন দেশের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করছে।

দুর্গাপূজার সমৃদ্ধ অর্থনীতি
এই সময়ে নতুন পোশাক, চমকপ্রদকৃত ডিজাইনের গহনা, আলোকসজ্জা, খাদ্য, পরিবহন এবং পর্যটন খাতে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়, যা অর্থনীতিকে বেগবান করে তোলে। উৎসবটি এই ব্যবসাগুলোর জন্য একটি অর্থনৈতিক বুস্টার হিসেবে কাজ করে। পূজার অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান থাকে খুচরো বা রিটেল সেক্টরের।

পূজার প্রস্তুতি সাধারণত মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয়। দুর্গাপ্রতিমা তৈরির মাধ্যমে কারিগর এবং প্রতিমা শিল্পীরা ব্যতিক্রমী এবং শৈল্পিকতার সুনিপুণ দক্ষতা প্রদর্শন করে। জেলায় জেলায় শারদ বাণিজ্যের সুফল পাচ্ছে বাংলার কৃষক, শ্রমজীবী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ।

গ্রামের বাঁশ বাগান থেকে উচ্চমূল্যে বাঁশ ট্রাকভর্তি হয়ে পাড়ি দিচ্ছে শহরের বিভিন্ন পূজামণ্ডপে, কুমোর পাড়ায়। একেক একটি মণ্ডপে প্রধান প্রতিমাশিল্পী ছাড়াও একাধিক সহকারী কাজ করেন। এ মানুষগুলোর জীবিকার প্রধান উৎস হলো দুর্গাপূজা। এর সঙ্গে রয়েছে রং, মাটি ও প্রতিমা তৈরির অন্যসব উপকরণ, যা তৈরিতে আরও কিছু মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়।

প্রতিমা তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে যে অর্থ পাওয়া যায় তা অনেক পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখে। পূজার মৌসুমে বাড়তি কিছু রোজগার তাদের নিত্য অভাব মেটাতে না পারলেও মুখে একটু হাসি ফোটায়। দুর্গাপূজার সময় ফল, ফুল এবং অন্যান্য পূজার সামগ্রীর চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়, পূজার প্রধান উপকরণ হিসেবে প্রচুর ফল, ফুল বিক্রি করে বিক্রেতাদের আয় বৃদ্ধি পায়, যা পুরো কৃষি অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে।

এই ফল, ফুল ব্যবসায়ীরা শুধুমাত্র ফল, ফুল বিক্রি করেই নয়, অন্যান্য সহযোগী ব্যবসা যেমন পরিবহন এবং সরবরাহের মাধ্যমেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখে, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়ায়।

বর্তমানে শহরগুলোয় এখন থিম পূজার হিড়িক। থিম পূজাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ শিল্পীদেরও রোজগার ও স্বীকৃতি উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া এই থিমের কাজে কবি-সাহিত্যিক, নাট্যকার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চিত্রশিল্পীরা ও আলোকসজ্জার সাথে সংশ্লিষ্টরা কাজে নিয়োজিত থাকায় তাদের জীবিকারও উন্নতি ঘটে।

পূজার সময় ঢাকি সম্প্রদায়ের কদর বাড়ে এবং তাদের আয়ের পরিমাণ বাড়ে। কারুশিল্প শুধুমাত্র দেশে নয়, অন্যান্য দেশেও প্রদর্শিত হয়, প্রতিমা এবং সাজসজ্জার বিশ্বব্যাপী বাজার সৃষ্টি হয়। বিদেশে প্রতিমা ও আনুষঙ্গিক পূজার উপকরণ এমনকি বাংলার ঢাকিরাও পাড়ি দেন। প্রতিমা বিসর্জনের সময় মাঝি-মল্লারদের আয়ও অনেক বেড়ে যায়। পূজা শেষে মণ্ডপ ভাঙা, পূজার স্থান পূজা-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ারও খরচ আছে এবং যার সাথে জড়িয়ে আছে শ্রমজীবীর আয়।

পূজার মৌসুমে নানা অফার, ডিসকাউন্ট, বিশেষ ছাড়ে পণ্য বিক্রি, সাহিত্য প্রকাশনা ইত্যাদি চলতে থাকে। ছোট বড় মাঝারি কাপড়, জুতা, প্রসাধনী দোকান এক দুই মাস আগে থেকেই পসরা সাজিয়ে বিশেষ ডিসকাউন্ট ঘোষণা করে। শাঁখা, পলা, আলতা, টিপ ও সিঁদুরের বাজারে লাগে পালের দোলা।

পত্রিকায়, টিভি, অনলাইন, ফেসবুকে লাগে বিজ্ঞাপনের ধুম। এই সময়ে নতুন নতুন কালেকশন লঞ্চ করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের দেওয়া পূজার উৎসব ভাতা এই সময়কালে বাড়তি কেনাকাটায় সহায়তা করে।

শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর বিভিন্ন বাণিজ্যিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। কৃষি, বিনোদন, ডেকোরেটার্স, সাউন্ড সিস্টেম, আলোক শিল্প, রং শিল্প, বিজ্ঞাপন, প্রতিমা, পূজার উপকরণ, ঢাকি, পুরোহিত, নাটক-যাত্রা-থিয়েটার শিল্প, মিষ্টান্ন শিল্প, খাদ্যশিল্প, স্বর্ণশিল্প, বস্ত্র শিল্প, ভ্রমণ শিল্প প্রভৃতি বিভাগে বিশাল অর্থের আদানপ্রদান হয়।
এখন সবাই মোবাইলে আঙুল চালনায় ব্যস্ত, যদি অনলাইনে মনমতো পূজার জিনিস পাওয়া যায়। পূজার মৌসুমে অনলাইন ব্যবসা এখন শহরের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম-গঞ্জেও আধিপত্য বেড়েছে। বিভিন্ন নামীদামি কোম্পানিগুলো অপেক্ষায় থাকে পূজার সময়ে কোটি কোটি টাকা স্পন্সর করে বাণিজ্যিক লাভের আশায়। পূজামণ্ডপে ঘোরাঘুরিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের খাবার ও পানীয়ের বিক্রি বাড়ে। হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ফুড কোর্টগুলোয় গ্রাহকদের ভিড় বাড়ে।

বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পাঁচ দিনে পূজামণ্ডপের প্যান্ডেলের আশেপাশে ছোটখাটো স্টল এবং অস্থায়ী বাজার স্থাপন করা। এই স্টলগুলো ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং গয়না থেকে শুরু করে পোশাক এবং খাবার পর্যন্ত বিস্তৃত পণ্য সরবরাহ করে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য এটি শুধুমাত্র প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে না বরং ছোট-বড় ব্যবসাও সমর্থন করে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড অর্থনৈতিক পরিধিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।

পূজা উপলক্ষে অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকায় এই উৎসরে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। পর্যটকদের আগমনের ফলে হোটেলগুলোয় রুমের চাহিদা বাড়ে এবং পরিবহন খাতেও ব্যবসা বৃদ্ধি পায়।

দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার এইবারও ভারতে মোট এক হাজার ২০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। এ অনুমতি দেওয়া হয়েছে ৩৭টি প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ টন, ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৩০ টন করে ৭৫০ টন, ৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৪০ টন করে ৩৬০ টন এবং দু’টি প্রতিষ্ঠানকে ২০ টন করে ৪০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবরের মধ্যে অনুমোদনকৃত ইলিশ রপ্তানি শেষ করতে হবে। প্রতিকেজি ইলিশের রপ্তানি মূল্য ১২ দশমিক ৫ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে বাংলাদেশের ইলিশের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এই পদক্ষেপকে তারা ‘পূজার উপহার’ হিসেবেই দেখে থাকেন। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।

শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর বিভিন্ন বাণিজ্যিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। কৃষি, বিনোদন, ডেকোরেটার্স, সাউন্ড সিস্টেম, আলোক শিল্প, রং শিল্প, বিজ্ঞাপন, প্রতিমা, পূজার উপকরণ, ঢাকি, পুরোহিত, নাটক-যাত্রা-থিয়েটার শিল্প, মিষ্টান্ন শিল্প, খাদ্যশিল্প, স্বর্ণশিল্প, বস্ত্র শিল্প, ভ্রমণ শিল্প প্রভৃতি বিভাগে বিশাল অর্থের আদানপ্রদান হয়।

আজ দুর্গাপূজা একটি বিশাল ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিও। এটি অর্থনৈতিকভাবেও সর্বজনীনতা লাভ করেছে, যা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে এক সূত্রে বাঁধে। এতে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয় এবং বিভিন্ন ব্যবসার প্রসার ঘটে, যা সমগ্র দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

দুর্গাপূজা শুধু উৎসব নয় বরং এটি শান্তি ও অপশক্তি বিনাশের বার্তাবাহক। দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের মাধ্যমে যেমন অপশক্তির বিনাশ হয়, তেমনই এই পূজা মানব মনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ঐক্যের বার্তা নিয়ে আসে। এই উৎসব মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে প্রকৃতির সঙ্গে আত্মিক যোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে সবসময়।

রুনা সাহা : সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Tag :

আপনার মন্ত্রব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয়

দুর্গাপূজার শক্তিশালী অর্থনৈতিক বিস্তার

দুর্গাপূজার শক্তিশালী অর্থনৈতিক বিস্তার

Update Time : ০৬:৫৩:২৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শরতের শুভ্র আকাশ, কাশফুলের হাওয়ার নাচন, শিশির ভেজা ঘাসের ওপর শিউলি ফুল আর আগমনী ঢাক-শাঁখের আওয়াজ জানান দিচ্ছে গৌরি মর্তলোকে এলো বলে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একাধিক ধর্মীয় উৎসব থাকলেও, আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতার দিক থেকে দুর্গাপূজাই বড় আসনটি দখল করে রেখেছে।

দুর্গোৎসব কেবল ধর্মীয় উৎসবই নয়, এটি একটি সর্বজনীন উৎসব যেখানে ঐতিহ্য, পরম্পরা, খাওয়া-দাওয়া, সংস্কৃতি, আচার, ঘোরাঘুরি, বাণিজ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। হিন্দু ঐতিহ্যের গভীরে নিহিত এই উৎসব শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি এত উৎসাহ এবং অন্তর্ভুক্তির সাথে উদযাপিত হয় যে যেখানে সব স্তরের, সব শ্রেণিপেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেয়।

অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর অনেক মানুষই এই উৎসবের আচার-অনুষ্ঠান, পূজার প্যান্ডেল পরিদর্শনসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উৎসাহ উদ্দীপনায় উপভোগ করে। এই উন্মুক্ত উদযাপন এবং ধর্মীয় সহনশীলতা বাংলাদেশকে এক ধর্মীয় নিরপেক্ষ জাতির উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে।

গোটা বাংলায় সপরিবারে দুর্গা প্রতিমার পূজার প্রচলন প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৪৮০ সালে রাজশাহীর জেলার তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণের পূজায়। তবে বাংলায় পারিবারিক দুর্গাপূজার প্রচলন মোটামুটি ১৬১০ সালে বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পূজা আয়োজনের মাধ্যমে।

শরৎকালীন দুর্গাপূজার সর্বোচ্চ প্রসার ও প্রচার লাভ করে ১৭৫৭ সালে কৃষ্ণনগরের অধিপতি নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর এবং শোভাবাজার রাজবাড়ীর পূজা আয়োজনের পর থেকেই। ইতিহাসে কথিত আছে, জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে পলাশীর যুদ্ধ জয়ের পরে ক্লাইভ গির্জায় না গিয়ে আনন্দ উৎসবের জন্য দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন।

আগে সমাজের বর্ধিষ্ণু সম্প্রদায়—জমিদার, তালুকদার বা অন্যান্য বৈভবশালী পরিবারই দুর্গাপূজা করতেন। কালের অন্তরালে বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার পর পূজায় ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়। ১৭৯০ সালে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার বারোজন ব্রাহ্মণ যুবকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল দুর্গাপূজার। বারো ইয়ার বা বন্ধু মিলে ওই পূজা ‘বারোইয়ারি’ বা ‘বারোয়ারি’ পূজা নামে খ্যাত হয়ে আছে। সেদিনের সেই ‘বারোয়ারি’ কথাটি ধীরে ধীরে আজকের ‘সর্বজনীন’-এ রূপ নেয়।

দুর্গাপূজা ধর্মীয় তাৎপর্যের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। জীবনের সব রং ছুঁয়ে পূজার অর্থনৈতিক প্রভাব শুধু শহরে সীমাবদ্ধ থাকে না, গ্রাম থেকে শুরু করে মফস্বল পর্যন্ত সর্বত্র এর প্রভাব দেখা যায়। ব্যবসা বাণিজ্যে আসে গণজোয়ার।
পরিসংখ্যানিক হিসাব মতে বাংলাদেশে ২০২১ সালে পূজামণ্ডপের সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ১২২। ২০২২ সালে মণ্ডপের সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ হাজার ১৬৮-এ, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে দুর্গাপূজার মোট মণ্ডপের সংখ্যা ছিল ৩২,৪৬০টি, ২০২৪ সালে এটি কমে ৩১,৪৬১টি মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০২৫ সালে সারা বাংলাদেশে মোট ৩৩ হাজার ৫৭৬টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধি মণ্ডপ বৃদ্ধির কারণ নয়। যেহেতু মণ্ডপের সঙ্গে ভিন্ন মাত্রার মর্যাদা জড়িত এবং তাই আর্থিক সংকুলানের ব্যবস্থা করতে পারলেই মণ্ডপের সংখ্যা বাড়ে। ব্যক্তিগত আর্থিক কার্যকলাপের সাথে সাথে বর্তমানে সরকারি আর্থিক প্রণোদনা যোগ হচ্ছে। দেশের সব দুর্গাপূজা মণ্ডপের জন্য ২০২৩ সালের সরকারি বরাদ্দ ছিল ২ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে দুর্গাপূজা উদযাপনের জন্য ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। ২০২৫ পূজায় সরকারের পক্ষ থেকে ৫ কোটি টাকার অনুদান দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

দুর্গাপূজার মূল পাঁচ দিন হলো ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং বিজয়া দশমী। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথি থেকে এই পাঁচ দিনের দুর্গোৎসব শুরু হয় এবং বিজয়া দশমীর মাধ্যমে শেষ হয়। বেশ কিছু মণ্ডপে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয় মহাষ্টমী তিথিতে, যেখানে নবদুর্গার নয়টি রূপকে প্রতিনিধিত্বকারী কুমারী কন্যাদের দেবী রূপে পূজা করা হয়।

কুমারী পূজার মাধ্যমে একদিকে যেমন নারীর পবিত্রতা ও সম্মানকে তুলে ধরা হয়, তেমনই সমাজের নারীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। এর ফলে সমাজে নারী শিক্ষা ও নারীর কর্মসংস্থানেও পরোক্ষভাবে উৎসাহিত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। জাতি, ধর্ম, বর্ণের ঊর্ধ্বে শারদোৎসব।

যে বৈদিক সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণে দেবীর আরাধনা হয় সেই সংস্কৃত শব্দকোষে কেবল সব মনুষ্য জাতির নয়, রয়েছে জগতের সব পশুপাখি এবং গাছপালাসহ সবার মঙ্গল কামনার উদাত্ত প্রকাশ। বিজয়া দশমী অশুভ শক্তির ওপর বিজয়ের প্রতীক এবং এর মাধ্যমে মন্দের বিনাশের বার্তা দেওয়া হয়। দশমীতে মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে মিষ্টান্ন শিল্প, খাদ্যশিল্পে যোগ হয় বিক্রয়ের দোলা।

বর্তমানে দুর্গাপূজা শুধু মন্ত্র উচ্চারণ ও আচার অনুষ্ঠান পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন দুর্গাপূজা ধর্মীয় তাৎপর্যের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। জীবনের সব রং ছুঁয়ে পূজার অর্থনৈতিক প্রভাব শুধু শহরে সীমাবদ্ধ থাকে না, গ্রাম থেকে শুরু করে মফস্বল পর্যন্ত সর্বত্র এর প্রভাব দেখা যায়। ব্যবসা বাণিজ্যে আসে গণজোয়ার।

সব মিলে মিশে দুর্গাপূজা বর্তমানে এক মহা মিলনমেলা ও বাণিজ্যমেলায় পরিণত হয়েছে। সামাজিক বিনিয়োগের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন সামাজিক বন্ধনকে মজবুত করে। যোগ হয় সাংস্কৃতিক বিনিয়োগও। পূজা এখন দেশের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করছে।

দুর্গাপূজার সমৃদ্ধ অর্থনীতি
এই সময়ে নতুন পোশাক, চমকপ্রদকৃত ডিজাইনের গহনা, আলোকসজ্জা, খাদ্য, পরিবহন এবং পর্যটন খাতে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়, যা অর্থনীতিকে বেগবান করে তোলে। উৎসবটি এই ব্যবসাগুলোর জন্য একটি অর্থনৈতিক বুস্টার হিসেবে কাজ করে। পূজার অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান থাকে খুচরো বা রিটেল সেক্টরের।

পূজার প্রস্তুতি সাধারণত মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয়। দুর্গাপ্রতিমা তৈরির মাধ্যমে কারিগর এবং প্রতিমা শিল্পীরা ব্যতিক্রমী এবং শৈল্পিকতার সুনিপুণ দক্ষতা প্রদর্শন করে। জেলায় জেলায় শারদ বাণিজ্যের সুফল পাচ্ছে বাংলার কৃষক, শ্রমজীবী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ।

গ্রামের বাঁশ বাগান থেকে উচ্চমূল্যে বাঁশ ট্রাকভর্তি হয়ে পাড়ি দিচ্ছে শহরের বিভিন্ন পূজামণ্ডপে, কুমোর পাড়ায়। একেক একটি মণ্ডপে প্রধান প্রতিমাশিল্পী ছাড়াও একাধিক সহকারী কাজ করেন। এ মানুষগুলোর জীবিকার প্রধান উৎস হলো দুর্গাপূজা। এর সঙ্গে রয়েছে রং, মাটি ও প্রতিমা তৈরির অন্যসব উপকরণ, যা তৈরিতে আরও কিছু মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়।

প্রতিমা তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে যে অর্থ পাওয়া যায় তা অনেক পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখে। পূজার মৌসুমে বাড়তি কিছু রোজগার তাদের নিত্য অভাব মেটাতে না পারলেও মুখে একটু হাসি ফোটায়। দুর্গাপূজার সময় ফল, ফুল এবং অন্যান্য পূজার সামগ্রীর চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়, পূজার প্রধান উপকরণ হিসেবে প্রচুর ফল, ফুল বিক্রি করে বিক্রেতাদের আয় বৃদ্ধি পায়, যা পুরো কৃষি অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে।

এই ফল, ফুল ব্যবসায়ীরা শুধুমাত্র ফল, ফুল বিক্রি করেই নয়, অন্যান্য সহযোগী ব্যবসা যেমন পরিবহন এবং সরবরাহের মাধ্যমেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখে, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়ায়।

বর্তমানে শহরগুলোয় এখন থিম পূজার হিড়িক। থিম পূজাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ শিল্পীদেরও রোজগার ও স্বীকৃতি উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া এই থিমের কাজে কবি-সাহিত্যিক, নাট্যকার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চিত্রশিল্পীরা ও আলোকসজ্জার সাথে সংশ্লিষ্টরা কাজে নিয়োজিত থাকায় তাদের জীবিকারও উন্নতি ঘটে।

পূজার সময় ঢাকি সম্প্রদায়ের কদর বাড়ে এবং তাদের আয়ের পরিমাণ বাড়ে। কারুশিল্প শুধুমাত্র দেশে নয়, অন্যান্য দেশেও প্রদর্শিত হয়, প্রতিমা এবং সাজসজ্জার বিশ্বব্যাপী বাজার সৃষ্টি হয়। বিদেশে প্রতিমা ও আনুষঙ্গিক পূজার উপকরণ এমনকি বাংলার ঢাকিরাও পাড়ি দেন। প্রতিমা বিসর্জনের সময় মাঝি-মল্লারদের আয়ও অনেক বেড়ে যায়। পূজা শেষে মণ্ডপ ভাঙা, পূজার স্থান পূজা-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ারও খরচ আছে এবং যার সাথে জড়িয়ে আছে শ্রমজীবীর আয়।

পূজার মৌসুমে নানা অফার, ডিসকাউন্ট, বিশেষ ছাড়ে পণ্য বিক্রি, সাহিত্য প্রকাশনা ইত্যাদি চলতে থাকে। ছোট বড় মাঝারি কাপড়, জুতা, প্রসাধনী দোকান এক দুই মাস আগে থেকেই পসরা সাজিয়ে বিশেষ ডিসকাউন্ট ঘোষণা করে। শাঁখা, পলা, আলতা, টিপ ও সিঁদুরের বাজারে লাগে পালের দোলা।

পত্রিকায়, টিভি, অনলাইন, ফেসবুকে লাগে বিজ্ঞাপনের ধুম। এই সময়ে নতুন নতুন কালেকশন লঞ্চ করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের দেওয়া পূজার উৎসব ভাতা এই সময়কালে বাড়তি কেনাকাটায় সহায়তা করে।

শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর বিভিন্ন বাণিজ্যিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। কৃষি, বিনোদন, ডেকোরেটার্স, সাউন্ড সিস্টেম, আলোক শিল্প, রং শিল্প, বিজ্ঞাপন, প্রতিমা, পূজার উপকরণ, ঢাকি, পুরোহিত, নাটক-যাত্রা-থিয়েটার শিল্প, মিষ্টান্ন শিল্প, খাদ্যশিল্প, স্বর্ণশিল্প, বস্ত্র শিল্প, ভ্রমণ শিল্প প্রভৃতি বিভাগে বিশাল অর্থের আদানপ্রদান হয়।
এখন সবাই মোবাইলে আঙুল চালনায় ব্যস্ত, যদি অনলাইনে মনমতো পূজার জিনিস পাওয়া যায়। পূজার মৌসুমে অনলাইন ব্যবসা এখন শহরের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম-গঞ্জেও আধিপত্য বেড়েছে। বিভিন্ন নামীদামি কোম্পানিগুলো অপেক্ষায় থাকে পূজার সময়ে কোটি কোটি টাকা স্পন্সর করে বাণিজ্যিক লাভের আশায়। পূজামণ্ডপে ঘোরাঘুরিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের খাবার ও পানীয়ের বিক্রি বাড়ে। হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ফুড কোর্টগুলোয় গ্রাহকদের ভিড় বাড়ে।

বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পাঁচ দিনে পূজামণ্ডপের প্যান্ডেলের আশেপাশে ছোটখাটো স্টল এবং অস্থায়ী বাজার স্থাপন করা। এই স্টলগুলো ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং গয়না থেকে শুরু করে পোশাক এবং খাবার পর্যন্ত বিস্তৃত পণ্য সরবরাহ করে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য এটি শুধুমাত্র প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে না বরং ছোট-বড় ব্যবসাও সমর্থন করে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড অর্থনৈতিক পরিধিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।

পূজা উপলক্ষে অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকায় এই উৎসরে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। পর্যটকদের আগমনের ফলে হোটেলগুলোয় রুমের চাহিদা বাড়ে এবং পরিবহন খাতেও ব্যবসা বৃদ্ধি পায়।

দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার এইবারও ভারতে মোট এক হাজার ২০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। এ অনুমতি দেওয়া হয়েছে ৩৭টি প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ টন, ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৩০ টন করে ৭৫০ টন, ৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৪০ টন করে ৩৬০ টন এবং দু’টি প্রতিষ্ঠানকে ২০ টন করে ৪০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবরের মধ্যে অনুমোদনকৃত ইলিশ রপ্তানি শেষ করতে হবে। প্রতিকেজি ইলিশের রপ্তানি মূল্য ১২ দশমিক ৫ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে বাংলাদেশের ইলিশের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এই পদক্ষেপকে তারা ‘পূজার উপহার’ হিসেবেই দেখে থাকেন। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।

শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর বিভিন্ন বাণিজ্যিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। কৃষি, বিনোদন, ডেকোরেটার্স, সাউন্ড সিস্টেম, আলোক শিল্প, রং শিল্প, বিজ্ঞাপন, প্রতিমা, পূজার উপকরণ, ঢাকি, পুরোহিত, নাটক-যাত্রা-থিয়েটার শিল্প, মিষ্টান্ন শিল্প, খাদ্যশিল্প, স্বর্ণশিল্প, বস্ত্র শিল্প, ভ্রমণ শিল্প প্রভৃতি বিভাগে বিশাল অর্থের আদানপ্রদান হয়।

আজ দুর্গাপূজা একটি বিশাল ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিও। এটি অর্থনৈতিকভাবেও সর্বজনীনতা লাভ করেছে, যা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে এক সূত্রে বাঁধে। এতে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয় এবং বিভিন্ন ব্যবসার প্রসার ঘটে, যা সমগ্র দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

দুর্গাপূজা শুধু উৎসব নয় বরং এটি শান্তি ও অপশক্তি বিনাশের বার্তাবাহক। দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের মাধ্যমে যেমন অপশক্তির বিনাশ হয়, তেমনই এই পূজা মানব মনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ঐক্যের বার্তা নিয়ে আসে। এই উৎসব মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে প্রকৃতির সঙ্গে আত্মিক যোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে সবসময়।

রুনা সাহা : সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়