শিক্ষক দিবসে ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া বৃদ্ধি শিক্ষকদের সঙ্গে ‘তামাশা’
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশে আজ পালিত হচ্ছে শিক্ষক দিবস। দিবসটিতে শিক্ষকদের নিয়ে চলেছে আলোচনা ও স্মৃতিচারণা। একই সঙ্গে উঠে আসছে দেশের শিক্ষকদের নানা বঞ্চনার কথাও। শিক্ষক দিবস উপলক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠানেও সকাল থেকে চলছিল ‘হা-হুতাশ’ আর ‘সহানুভূতিমূলক বক্তব্য’। বেলা গড়িয়ে দুপুর হতেই ‘দুঃসংবাদ’ পেয়েছেন দেশের সাড়ে পাঁচ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী।
শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মুখে বাড়িভাড়া বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। তারা মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া দাবি করলেও সরকার নামমাত্র ৫০০ টাকা বাড়িয়ে পরিপত্র জারি করে। ফলে এখন শিক্ষকদের মাসিক বাড়িভাড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা, যা খুবই অপ্রতুল।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বলছেন, নানা নাটকীয়তার পর মহান শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানানো তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের সঙ্গে প্রতারণা ও ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে। এটা তারা মানতে পারছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা মাত্র ১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া ভাতা পান। এ ভাতা বাড়ানোর দাবি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে কয়েক দফায় টানা আন্দোলন করেছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষকদের বাড়িভাড়া বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছিল।
১৩ আগস্ট এক আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ ১ হাজার টাকা বাড়িয়ে বাড়িভাড়া দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষকরা তা মেনে নেননি। তাদের দাবি ছিল—মূল বেতনের ওপর কমপক্ষে ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া ভাতা দিতে হবে।
শিক্ষকদের এমন দাবি উপেক্ষা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে বাড়িভাড়া এক হাজার টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়। এতে আপত্তি জানিয়ে শিক্ষকরা আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ঢাকায় লাগাতর অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
পরে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ জানায়, আগের প্রস্তাব বাতিল হয়েছে। নতুন করে ৫, ১০, ১৫ ও ২০ শতাংশ হারের হিসাব কষে শতাংশ হারে বাড়িভাড়া দিতে প্রস্তাব পাঠানো হবে। রোববার (৫ অক্টোবর) এ প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
অথচ ৩০ সেপ্টেম্বর পূজার ছুটির আগে শেষ কর্মদিবসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে শিক্ষকদের বাড়িভাড়া মাত্র ৫০০ টাকা বাড়ানোর কথা জানানো হয়। রোববার (৫ অক্টোবর) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে যখন বিশ্ব শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান চলছিল, তখনই শিক্ষকরা ৫০০ টাকা বাড়ানোর এ পরিপত্র পান। মুহূর্তেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন তারা।
গত আগস্টে জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের ডাকে ঢাকায় মহাসমাবেশে এসেছিলেন ভোলার শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের বাড়িভাড়া শতাংশ হারে দেওয়ার প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে চেয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ আমরা জানতে পারলাম গত ৩০ সেপ্টেম্বর ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া বাড়িয়ে একটা পরিপত্র জারি হয়েছে। শিক্ষক দিবসে এমন খবর জেনে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে অনুভব করছি। সরকার চরম ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে।
রাজবাড়ীর শিক্ষক আব্দুল সালাম বলেন, শিক্ষক দিবসে সকালে যে অনুষ্ঠান হয়েছে সেটা টিভিতে বসে দেখছিলাম। শিক্ষা উপদেষ্টা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা, ইউজিসির চেয়ারম্যানসহ অনেকে বক্তব্য দিলেন। সেখানে তারা শিক্ষকদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলে খুবই সহানুভূতি দেখালেন। অথচ দুপুরের পর জানতে পারলাম দীর্ঘদিন শিক্ষকরা বাড়িভাড়া বাড়ানোর জন্য যে দাবি জানিয়ে আসছেন, তা নিয়ে খুবই বাজে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মাত্র ৫০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এটা শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের সঙ্গে তামাশা ছাড়া কিছু্ই না।
৫০০ টাকা বাড়িভাড়া বাড়িয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় যে পরিপত্র জারি করেছে, তা দেশের শিক্ষক সমাজ প্রত্যাখ্যান করেছে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন আজিজী।
আমরা এ পরিপত্র প্রত্যাখ্যান করেছি, শিক্ষকসমাজ এটা মানবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, আজই শতাংশ হারে বাড়িভাড়া বাড়াতে আরেকটা প্রস্তাব তারা পাঠাবেন। আমরা তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়েছি। তবে তা ১২ অক্টোবরের আগেই করতে হবে। অন্যথায় ১২ অক্টোবর থেকে সারাদেশের শিক্ষকরা ঢাকায় যাবেন, লাগাতর অবস্থান কর্মসূচি করবেন। তখন সরকার চাইলেও শিক্ষকদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
শিক্ষক দিবস উপলক্ষে রোববার সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভা ও গুণী সম্মাননা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার বলেন, আমরা শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও বাড়িভাড়াসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে শিক্ষকদের জীবনযাপনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরবে।
শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ডা. বিধান রায় পোদ্দার বলেন, বেতন ও ভাতা প্রাপ্তির দিক দিয়ে সবচেয়ে নিচে রয়েছেন আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা। তারা ১৩তম গ্রেড পান। একজন কম্পিউটার অপারেটরও একই স্কেল পান। এই হচ্ছে তার সম্মান। সরকারি কলেজের অধ্যাপকের স্কেল চতুর্থ গ্রেড। অর্থাৎ একজন যুগ্ম সচিবেরও নিচে অবস্থান করেন। আমরা এ মর্যাদা দিচ্ছি শিক্ষকদের। সুতরাং শিক্ষকদের যদি সত্যি মর্যাদা দিতে হয়, তাহলে শুধু মুখের কথায় চিড়া ভিজবে না। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আজ মহান শিক্ষক দিবস। আজকের আলোচনায় শিক্ষকদের কেমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত, সেটাই মুখ্য বিষয়। আমরা তাদের কী ধরনের বেতন-ভাতা দিচ্ছি এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কেমন দেওয়া উচিত; তা বিচার-বিশ্লেষণ করা জরুরি। গভীর মনোযোগের সঙ্গে আমাদের চিন্তা করতে হবে।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব সাইয়েদ এ জেড মোরশেদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, আগে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। সেটা পরে আর প্রাসঙ্গিক নেই। তবে সেটা ধরে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। সেখানে ৫০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে; এটা সত্য।
তিনি আরও বলেন, তবে শিক্ষা উপদেষ্টা পরে শিক্ষকদের মূল বেতনের ওপর শতাংশ হারে বাড়িভাড়া দিতে আরেকটি ফাইল প্রস্তুত করতে বলেন। তাতে তিনি অনুমোদনও দিয়েছেন। আমরা আজই এ ফাইল অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর চেষ্টা করছি। আশা করি, শতাংশ হারে অর্থ মন্ত্রণালয় শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করবেন। তখন ৫০০ টাকা বাড়িয়ে যে পরিপত্র সেটি অটোমেটিক বাতিল হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সবশেষ ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারাদেশে বর্তমানে মোট এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৬ হাজার ৪৪৭টি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষক এবং ১ লাখ ৭৭ হাজার কর্মচারী।
বর্তমানে দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা মাসে বাড়িভাড়া বাবদ এক হাজার টাকা পান। আর চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা। ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানোর পরিপত্র জারি হওয়ায় তারা এখন থেকে ১৫০০ টাকা করে পাবেন।












